কৃষ্ণকলি

শিশির's picture
শিশির মঙ্গল, ২০২৩-০৯-১৯ ০২:২৬
Crow_Cutout.JPG

[যশোরের স্মৃতিছায়ায়, বিলেতে ২০০৯-এর কোনো এক মাসে, আমার ১৯৯১-এর ডায়েরি'তে লেখা কয়েকটি পাতা থেকে অপরিকল্পিতভাবেই এই ডিঙিগল্পটির উৎপত্তি... ]

যে সময়ের কথা বলছি, তখন মনে হতো দরজার ছিটকিনি টা লাগাতে পারার মত লম্বা হলেই বড় হয়ে যাবো; নিজের একটা সাইকেল পেলে যেমন খুশি হবো বলে ভাবতাম, আজকে কেউ রোলস রয়্যেস কিনেও এত খুশি হবে কিনা বলতে পারিনে… মানুষের সব ইচ্ছেই যদি পূরণ হতো তাহলে বোধকরি পৃথিবী এত সুন্দর হতো না…! আইনস্টাইনের সেই অদৃশ্য বংশীবাদক, যার যেখানে অবস্থান, তাকে ঠিক সেখানেই রেখে তার বাঁশী বাঁজিয়ে যাচ্ছেন অনন্তকাল ধরে…

গাছ থেকে বরাবর পেয়ারা পেড়েছি গাছে উঠেই। পেয়ারা গাছ আর শান বাঁধানো উঠোন মানেই আমার কাছে আমাদের বাড়ীর আজন্ম চিত্র। পেয়ারা গাছটা আমার গৃহাভ্যন্তরীন খেলার বস্তুর মতই প্রিয় ছিল, তবে তার ঋতূভিত্তিক পাতার রঙ-বদল আর আশ্চর্য্য ভাস্কর্যের মত পেটানো শরীর আমাকে মোহিত করতো আর তার চেয়েও মোহিত হতাম, নববিবাহিতা বঁধুর কানের ঝুঁমকোর মতই এর মায়ার শরীরে পেয়ারা দোল খেতো সারাটা বছরই । আমার অনবরত গাছে চড়ার কারনে এর শরীর যতটুকু মসৃন হয়েছিল তা বুঝি কোনো বিশ্বখ্যাত ভাস্কর্যকেও হার মানাবে। এই ছবির মত সুন্দর গাছটা হঠাৎ করে কেটে ফেলা হলো আর তার সাথে কাটা পড়লো আমার যাবতীয় সুতো, যেগুলো বাঁধা ছিল আমার প্রিয়তিপ্রিয় পাখিবঁধুদের সাথে। কৃষ্ণকলি…সেই পাখিবঁধুদেরই একজন।

বসতবাড়ী বন্টনের সময় ছোটচাচা এই বাড়ীতেই ওঠেন আমাদের সাথে আর উঠে পড়ে লাগেন, এই পেয়ারা গাছ কাটতেই হবে তা না হলে দালানের ক্ষতি। গাছের জন্যে ঘরে আলো ঢোকে না বলেও অভিযোগ করলেন। ছোট ভাইয়ের অভিযোগ গৃহিত ও বাস্তবায়িত হলো যদিও গাছটা ছিল বাবার দুরন্ত কৈশোরের জীবন্ত স্বাক্ষী, চারা গাছটা এনেছিলেন কোনো এক দূর জঙ্গল থেকে, বনভোজন শেষের আনন্দময় আবিস্কার। বাবার আফসোস ততটা প্রকট কিনা বোঝা গেলো না, কিন্তু আমি ভাবলাম, ইশ্‌, আমার দারুন সুন্দর পাখিগুলোকে আর এত কাছ থেকে দেখা হবেনা; ওটা শুধু আমার কাছে পেয়ারা গাছই ছিল না, ছিল উন্মুক্ত একটা পাখির খাঁচা।

আমার মায়ের জন্যেই এই গাছে এত পাখির আবির্ভাব, পাখিতে ঠোঁকানো কোনো পেয়ারা কেউ পাড়লে মা সেদিন আর ভাত মুখে নিতো না। স্কুল থেকে ফিরে এসে একদিন দেখি, একটা অল্প বয়সী কাক বসে আছে পেয়ারা গাছে, ইতি উতি তাকাচ্ছে চারিদিকে আর মাঝে মাঝে পায়ে চঁঞ্চু মুছে নিচ্ছে। ভরদুপুরে হঠাৎ রুনুঝুনু বৃষ্টি শুরু হলেও কাকটা ঠাঁই পেয়ারার ডালে বসে থেকে কাকভেঁজা হতে লাগলো আর গায়ের পালকগুলো চুপসে ওটাকে কাকের কংকাল মনে হলো। বেচারাকে ওভাবে ভিঁজতে দেখে ভাবলাম ওকে আমি যদি আমার কাছে আনতে পারতাম তো গামছা দিয়ে আলতো করে ওর গা মুছে দিতাম। পেয়ারা পাড়া লগা টা ওর পায়ের কাছে নিয়ে বার কয়েক চেষ্টা করতেই ও উঠে বসলো তাতে, কি ভেবে কে জানে…আমি দুরু দুরু বুকে ওকে নামিয়ে আনলাম মগডাল থেকে। এখনই উড়ে যাবে নাতো? না…যেভাবে ছিল সেভাবেই বসে থাকলো। আমি আলতো হাতে ওকে নিলাম… অনুভব করলাম কৃষ্ণকলি কাঁপছে কিছুটা, হয়তো ভয়ে, হয়তো ঠান্ডায়…

আমি আর কৃষ্ণকলি যেন তখন একাকার অসম বন্ধুত্বে, আমার ঘরে; ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, পালক ছুঁই… চঁঞ্চু ধরে দুষ্টুমি করি। কিছু ভাত এনে খেতে দিলে তা পড়ে থাকে, ছুঁয়েও দেখেনা। আমি মাকে বলি কৃষ্ণকলিকে পুষবো, মা বলে, পাগল তুই? কাক কেউ পোষে? আমি ওকে তরকারি দিয়ে ভাত মেখে দিই, কয়েকবার ঠোঁক দিয়ে রেখে দেয়। সন্ধ্যা নামলে আমি ওকে নিয়ে আমার পড়ার টেবিলে বসি, আর খুনসুটি করি ওর সাথে, এখনো ভালো করে উড়তে শেখেনি তাই বসেই থাকে আমার কাছে, উড়ে যায় না কোথাও। একটু পর খেয়াল করে দেখি ওর মাথা আস্তে আস্তে নেমে আসছে, চোখ বন্ধ… এক সময় বসে বসেই মাথা নুইয়ে ফেললো একেবারে…জীবনে প্রথম দেখলাম পাখির ঘুম…কৃষ্ণকলি ঘুম। রাতে ওকে পাশে নিয়েই শুয়ে পড়লাম, ওকে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম… কৃষ্ণকলি কি মনে রাখবে এই অসম বাঁসর রাতের কথা? কাক ডাকা ভোরে কৃষ্ণকলি আমার মশারী তোলপাড় করে ফেললো। সকালবেলা কত কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই খাওয়ানো গেলো না ওকে… সেই প্রথম শুনলাম মায়ের কাছে… সব ‘পাখি’ পোষ মানে না…!

লাগাতার কয়েক দিন পর্যন্ত কৃষ্ণকলিকে পেয়ারা গাছটায় এসে বসতে দেখেছি, ভালো লাগতো ভাবতে, শুধুমাত্র একটা দিন ওকে নিয়ে কত আনন্দে কেটেছে, কাক পোষার অবান্তর স্বপ্নে। দুদিন পরই পেয়ারা গাছটা কাটা পড়লো…

__________________

شيشير

অনি's picture
অপূর্ব - অপরিসীম মুগ্ধতা থাকল

অনি 1 সপ্তাহ 5 দিন আগে

অপূর্ব - অপরিসীম মুগ্ধতা থাকল

শিশির's picture
@অনি

শিশির 1 সপ্তাহ 5 দিন আগে

অজস্র শুভাশীর্বাদ জানাই প্রিয়... সতত শুভ ও মঙ্গল হোক...

আর্বানমিশুকে's picture
বিউটিফুল ব্রাদার!

আর্বানমিশুকে 1 সপ্তাহ 4 দিন আগে

বিউটিফুল ব্রাদার!

শৈলেশ সামন্ত's picture
একেবারে জীবন্ত!

শৈলেশ সামন্ত 1 সপ্তাহ 4 দিন আগে

একেবারে জীবন্ত!

শৈলেশ সামন্ত's picture
আপনার ১৯৯১-এর ডায়েরির প্রতি

শৈলেশ সামন্ত 1 সপ্তাহ 4 দিন আগে

আপনার ১৯৯১-এর ডায়েরির প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে গেল!

শ্রী's picture
পাঠে পরিপূর্ণ তৃপ্তি

শ্রী 1 সপ্তাহ 4 দিন আগে

পাঠে পরিপূর্ণ তৃপ্তি

তিয়াসা 's picture
নামটা খুব apt

তিয়াসা 1 সপ্তাহ 4 দিন আগে

নামটা খুব apt

তিয়াসা 's picture
পড়তে মিঠে লাগল

তিয়াসা 1 সপ্তাহ 4 দিন আগে

পড়তে মিঠে লাগল, বেশ লাগল, মন ভরে গেল

খায়রুল আহসান's picture
ছবিটা খুব সুন্দর, শিরোনামটা তার সাথে যথোপযুক্ত।

খায়রুল আহসান 2 দিন 4 ঘন্টা আগে

ছবিটা খুব সুন্দর, শিরোনামটা তার সাথে যথোপযুক্ত।
"আইনস্টাইনের সেই অদৃশ্য বংশীবাদক, যার যেখানে অবস্থান, তাকে ঠিক সেখানেই রেখে তার বাঁশী বাঁজিয়ে যাচ্ছেন অনন্তকাল ধরে" - চমৎকার লাগল এ গভীর ভাবনাটা। …

.....

ভালবাসা ভালবাসি....



নতুন মন্তব্য পাঠান

  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <b> <font color> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <small>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • You may use [inline:xx] tags to display uploaded files or images inline.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.
  • You may use <swf file="song.mp3"> to display Flash files inline