মুখে যার ভরা ভাদর

অসিত কুমার রায়'s picture
অসিত কুমার রায় সোম, ২০২৩-০৯-১১ ০৩:৪৮

- অসিত কুমার রায় (রক্তিম)
তোমায় অপার ভালবাসা পেলে
জানি আমার সকল ভয় কেটে যাবে।
তোমায় খুব কাছে পেলে
হৃদয় জুড়ে তৃষ্ণা মিটে যাবে।

তুমি যে কূল ছাড়া এক নাবিক
নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো পাখী।
শত তৃষায় পারবেনা দিতে পানি
জানি, তোমার তপ্ত কঠোর লবন আঁখি।

বারে বারে পাল্টে ফেলো বন্দর
রঙিন ফানুস মনে বাঁধো অস্থায়ী নোঙর।
এঘাট থেকে ওঘাটে করো ফেরি
মনে পড়ে তাকে, মুখে যার ভরা ভাদর।

আকাশের চিলও বাসায় ফিরে আসে
দিকচক্রবালে পলাশ ফোটে ফাগুন মাসে।
আশায় আশায় দিনতো চলে যায়
রাত্রি যেন ভয়ংকর আমি যে মরি ত্রাসে।

প্রমিত's picture
আপনার লেখাটি ভাল লাগল

প্রমিত 2 সপ্তাহ 6 দিন আগে

আপনার লেখাটি ভাল লাগল অসিতবাবু, জানিনা আপনি মন্তব্যের পাতায় আসেন কিনা, তাও একটি লেখা শেয়ার করছি আপনার সাথে, কারণ আপনার কবিতাটি পড়তে পড়তে সেই নস্টালজিয়া আক্রান্ত করল

লিখেছেন প্রণব আচার্য্য, কবি প্রণব আচার্য্য


অবশেষে তিনি মরে গেলেন।
তিনজন পাওনাদার মিলে তার কাছে মাত্র ৬০ হাজার পেতো; এক বন্ধু পেতো একটি অসমাপ্ত চিঠি। বন্ধুপত্নী পেতেন কয়েকটি জমজমাট রাতের আশ্বাস; চলমান প্রেমিকা পেতেন আরো একটি প্রতিশ্রুত সন্ধ্যার ঘনিষ্ঠতা; আর সাবেক একজন প্রেমিকা তাঁর বিয়ের দিন, যদি তিনি নিমন্ত্রণটি রক্ষা করতেন, তবে একটি বিবর্ণ উপহার পেতে পারতেন। অথচ এইসব বকেয়া রেখে তিনি মরে গেলেন।

তিনি যে মরে যাবেন এটা মোটামুটি আমি জানতাম। গত কয়েক বছর ধরেই তিনি একটি মহত্তম রোগে ভুগছিলেন। তার বুকে ছিলো গভীর গোপন বাষ্প। এই বাষ্প বুকে ধারণ করে দিনে দিনে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন একটি অভূতপূর্ব মৃত্যুর দিকে। তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, ‘দ্যাখ, মানুষের জন্মে তার নিজের হাত নেই। কিন্তু চাইলেতো মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু করতে পারে।’ আমি প্রথম প্রথম তার এ ধরনের কথায় কান দিতাম না। কিন্তু তার বলার ধরন এতোই স্বপ্নময় ছিলো যে তা অবিশ্বাস করাটা আমার কাছে রীতিমতো অপরাধই মনে হতে লাগলো।

তার কয়েকজন প্রেমিকার মধ্যে একজনের নাম ছিলো গহন। আশ্চর্য প্রায়ই তিনি গহনের কাছে চুম্বন প্রার্থনা করেতেন। আশ্চর্য বলছি এই কারণে, একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে চুম্বন প্রার্থনা করবে এটা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়, কিন্তু গহন কোনো মানবী ছিলো না, ফলে বিষয়টি আমরা কিংবা প্রাজ্ঞবয়জ্যাষ্ঠরা মানতে পারতাম না। তার ভাষায় গহন হচ্ছে শিল্পকলার বিমূর্ত বিস্ময়, লিথিয়াম আলোর আভার মতো ম্লান অথচ অপ্রতিরোধ্য। মূলত তখন থেকেই মহত্তম রোগটি তার মধ্যে সংক্রমিত হতে শুরু করে। তিনি যে রোগটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না এমন নয়, রোগটিকে বরং সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।

আমরা প্রায় সন্ধ্যায় তাকে থরথর করে কাঁপতে দেখতাম। সন্ধ্যায় সড়কের পাশে পথচারীদের বিবিধ দৃষ্টির সামনে একা একা কাঁপতেন তিনি। কখনো কখনো বিস্ময়াজীর্ণব্যূহ রচনা করে গভীর আগ্রহে, আবার কখনো নিতান্তই অনাগ্রহে আমরা তাকে দেখতাম। সকলেই ভাবতো নেশায় পড়ে লোকটা শেষ হয়ে গেল। তবে ঠিক কোনো নেশাবস্তুটি গ্রহণ করতেন কেউ জানতো না। আমি জানতাম; শুধু আমি। নিজের সৃষ্টির নেশায় এ রকম কাঁপতে আমি আর কাউকে দেখি নি কোনোদিন।

পিতা তাকে বর্জন করেছিলো; অথচ গহনকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু শেখেননি তিনি। বন্ধুপত্নীর কেশমুগ্ধ আবদার রক্ষা করতে যেয়ে দুইদিনেই তিন তিনজন পাওনাদার সৃষ্টি করেছিলেন অবলীলায়। এটা কেবল তিনিই পারতেন, কারণ ততোদিনে তার বুকের ভেতরের বিষণ্নবাষ্পে এ রোগ প্রলয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো। ফলে তিনি আরো বিশুদ্ধ ও নিখুঁত হয়ে উঠছিলেন। এর মধ্যে একদিন তিনি আমাকে জানালেন সহজতম মৃত্যু সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে; তবে মৃত্যুর সময় যন্ত্রণাজনিত ব্যঘাত যেন না ঘটে।

আমি যখন মৃত্যু বিষয়ক খোঁজ খবর নেয়ার কাজে ব্যস্ত, তিনি ফোন দিলেন একদিন; ‘কী, পেয়েছো কোনো উপায়? আমি আমতা আমতা করতেই বললেন, খুঁজতে থাকো; তোমাকে যে কারণে ফোন দিয়েছি তা হলো, আমার ভেতরে যে বাষ্প ঘনীভূত হচ্ছিলো, বিকশিত হচ্ছিলো আশ্চর্য সৌন্দর্য, অবিলম্বে তার সমাপ্তি দরকার। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এই ভয়াবহ সুন্দর থেকে আমি মুক্তি চাইছি। এবং আমার সময় হয়েছে ব্যাধিকে মহত্তম সংহতি দেয়ার।’ আমার সাথে এই ছিলো তার শেষ সংলাপ।

কবিতা আর মিথ্যাকে পাশাপশি রেখে তিনি রাতের খাবার খেতেন। কেউ টের পেতো না - না মিথ্যা, না কবিতা। আসলে তাদের দুজনকেই হারিয়ে দেয়ার স্বরলিপি রচনা করতেন, পরজয়ের নেশা তীব্র হলেও মাঝে মাঝে তিনি জয়ী হতে চাইতেন, জয়-পরাজয়ের মাঝামঝি কবিতা ও মিথ্যায় ভর করে তিনি চলে যেতেন মিথের দিকে। নিঃশব্দে বলে যেতেন, ‘কোথায় পাবো কলসি কন্যা, কোথায় পাবো দড়ি / তুমি হও গহিন গাঙ্গ, আমি ডুব্যা মরি।’
তিনি বলতেন, মানুষ জন্মগ্রহণ করে না। মানুষের জন্ম হয়। ঘাস-লতাপাতা-গরু-ভেড়া-সিংহ-শুয়োরের মতো মানুষও জন্মায়। নিজের জন্মকে গ্রহণ করার সুযোগ আসলে মানুষের নেই। তবে মৃত্যুকে গ্রহণ করার সুযোগ আছে। যেমন বাইবেলের মিথ্যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ব্র“নো করেছিলেন, যেমন মৃত্যুকে গ্রহণ করেছিলেন লোরকা, তেমনি আমিও মৃত্যুকে গ্রহণ করবো, পান করবো ইতিহাসের পৌণঃপুনিক বিস্ময়।
হ্যাঁ, মৃত্যুকে গ্রহণ করার ব্যপারে তিনি যথেষ্ট সিরিয়াস ছিলেন। আমরা প্রায়ই দেখতাম কিট্সের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তিনি হাঁটছেন শহরের সবচেয়ে দুর্বোধ্য রাস্তায়। তার একটি সবুজ বাইক ছিলো। সেই বাইকে চড়ে তিনি মাঝে মধ্যেই চলে যেতেন বোদলেয়ারের মেঘবাড়িতে। গভীর দুপুরের বৃষ্টি থেকে ফোঁটা ফোঁটা দুঃখ তুলে নিতেন, বুকের বাষ্পে। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখতাম তার ভেতরের বাষ্প কিভাবে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছিল। এ উষ্ণায়নের যৌনতায় তিনি নেশাগ্রস্থের মতো দুলতে থাকতেন; উচ্চারণ করতেন, ‘ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল, ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল …।’ তখন তার কাঁধ ছুঁয়ে যেতো একটি তন্বী স্পর্শ। সেই নাতিশীতোষ্ণ নম্রতায় তিনি স্থিরতা নামক আরোগ্য লাভ করতেন।

অথচ এইসব স্থিরতা, নৈঃশব্দ্য আর যূথচারী স্পর্শ উপেক্ষা করে বাষ্প আর বেদনার আহ্বানে এক কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তিনি নির্মোহ চিত্তে গ্রহণ করে নিলেন মৃত্যুকে।
স্বপ্ন ও মৃত্যু যে এতো ঘনিষ্ঠনৈকট্যে - জীবনবিমুখ শিশিরের শব্দে সেই প্রথম টের পেলাম আমি।

Ⓒ প্রণব আচার্য্য, মুক্তগদ্য ডট কমে প্রকাশিত

জামিল's picture
অসিত'দার কবিতাটা সত্যি

জামিল 2 সপ্তাহ 6 দিন আগে

অসিত'দার কবিতাটা সত্যি সুন্দর। তবে প্রণব আচার্য্যের লেখাটা পড়েও বিস্মিত হলাম!

শাহনূর's picture
"বারে বারে পাল্টে ফেলো

শাহনূর 2 সপ্তাহ 5 দিন আগে

"বারে বারে পাল্টে ফেলো বন্দর
রঙিন ফানুস মনে বাঁধো অস্থায়ী নোঙর।
এঘাট থেকে ওঘাটে করো ফেরি
মনে পড়ে তাকে, মুখে যার ভরা ভাদর।"

বুকে টান ধরিয়ে দেয় এমন সব ছত্র। এই যে আমাদের অনেকের আবর্তন বিবর্তন, এগুলো ইচ্ছাকৃত নয় ভাই, এগুলোকে অন্য কেউ আড়াল থেকে আমাদের'কে দিয়ে করিয়ে নেন সারাটা জীবন। তুমি কবিগুরুকে শ্রদ্ধা করো, ভালোবাসো, হয়তো বা পূজাও করো, আমিও তাই। আমারতো বেলা প্রায় শেষ, ভুল করে এদিক সেদিক ছুটে ছুটে কিসের সন্ধান করি সেটা নিজেই জানিনা, কিন্তু আমার সন্ধানে শেষ নেই, অথচ আমি জানি আমার শেষ আছে, তোমাকে পেয়ে ফের হারিয়ে ফেলার ভয় হয়, প্লিজ বন্ধ কোরোনা পাখা .....................

"যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,

মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা--
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।"

কি জানি কি লিখলাম, তবে অন্তর থেকে লিখলাম সেটা বিশ্বাস করে নিও!



নতুন মন্তব্য পাঠান

  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <b> <font color> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <small>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • You may use [inline:xx] tags to display uploaded files or images inline.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.
  • You may use <swf file="song.mp3"> to display Flash files inline